সমাইল খান শামিম হচ্ছেন একজন কৃষি উদ্যোক্তা, এর পাশাপাশি তিনি শিবগঞ্জ ম্যাংগো অ্যাসোসিয়েশনের সেক্রেটারি, আল্ট্রা হাই ডেনসিটি (ইউএইচডি) আম চাষের কৌশল অবলম্বন করে এই পদ অর্জন করেছেন। তার আম বাগানের এক অসাধারণ দৃশ্য রয়েছে, আর সেটা হচ্ছে বাগানের সব গাছ আমের ভারে নুইয়ে গেছে।
ইউএইচডি চাষের মডেলটি শিবগঞ্জ জুড়ে ব্যপক জনপ্রিয়তা অর্জন করেছে। কারণ আম চাষীরা এই পদ্ধতিটি ব্যবহার করার মাধ্যমে নিজেদের প্রয়োজন বা প্রত্যাশার চেয়েও অতিরিক্ত আয় পাচ্ছেন। আধুনিক এই কৃষি ব্যবস্থা তাদের অঞ্চলে ফসলের ধরণকে বৈচিত্র্যময় করার পাশাপাশি স্থানীয় অর্থনীতিতে একটি নতুন মাত্রা এনে দিয়েছে। প্রবৃদ্ধি হচ্ছে একটি স্থানীয় অর্থনৈতিক উন্নয়ন প্রকল্প, এটা শিবগঞ্জ ম্যাঙ্গো অ্যাসোসিয়েশনকে এই এলাকায় ইউএইচডি আম বাগান চালু করতে বেশ সাহায্য ও সহযগিতা করেছে। একজন কৃষি উদ্যোক্তা ও এই সমিতির সেক্রেটারি হওয়ার কারণে, শামীম ২০২১ সাল থেকে ইউএইচডি ফার্মিং মডেলের প্রচারের জন্য প্রবৃদ্ধির সঙ্গে ঘনিষ্ঠভাবে কাজ করছেন।ইসমাইল খান শামিম বলেন, ঐতিহ্যগতভাবে, আমরা প্রতি বিঘা জমিতে ৮ থেকে ১২ টি আমের গাছ লাগাতাম, যেখানে আনুমানিক ১.৩ টন আম উৎপাদন হতো। কিন্তু এই প্রবৃদ্ধি প্রকল্পের সাহায্যে ইউএইচডি পদ্ধতি অনুসরণ করার মধ্য দিয়ে আমি অল্প দুরত্বের মধ্যেই অন্তত ২০০ আম গাছ লাগিয়েছি এবং প্রতি মৌসুমে প্রায় ৪ থেকে ৫ টন আমের ফলন পেয়েছি। এরপর তিনি আরও বলেন, এই পদ্ধতিতে আমের গুনমান ভালো থাকে এবং এটা সংগ্রহ করা বেশ সহজ।
ইউএইচডি পদ্ধতির সুবিধা এর মধ্যেই প্রকাশ পেতে শুরু করেছে। বি-টু-বি মার্কেটিং এর কল্যানে প্রতি মণ (৪০ থেকে ৪৫ কেজি) আমের দাম পাওয়া যাচ্ছে ৮ থেকে ১০ হাজার টাকা পর্যন্ত। শামিম বলেন, আমরা স্থানীয় বাজারে প্রতি মণ (প্রায় ৫২ কেজি পর্যন্ত) মিশ্র আম বিক্রি করতাম ৫ থেকে ৬ হাজার টাকায়। তবে এখন আমরা আরও সঠিক হিসাবের সঙ্গে বি-টু-বি বাজারে প্রতি মণ আমের জন্য ৩ থেকে ৪ হাজার টাকা বেশি পাচ্ছি। তিনি গত কয়েক বছরে ইউএইচডি পদ্ধতি অনুসরণ করার ফলে নিজের জমি হতে প্রায় সাড়ে ৩ লাখ টাকা বেশি উপার্জন করেছেন। তিনি বলেন, এই চাষের ব্যবস্থা টি আসল অল্প সময়ের মধ্যে অতিরিক্ত ফলন পাওয়া এবং জমির সঠিক ব্যবহারে ভালো করে সাহায্য করে।
এরকম অভাবনীয় সাফল্য পাওয়ার কারনে ম্যাংগো এ্যাসোসিয়েশন কমিটি এলাকার প্রায় ৫০০ চাষিদের নিয়ে গঠিত এরকম অসাধারণ বাগানের প্রদর্শনের জন্য পৌরসভার মধ্যে ১০ টি ডেমো প্লটের তৈরি করেছে। এরই মধ্যে আশেপাশে থাকা প্রায় ২০০ চাষি নিজেদের ঐতিহ্যবাহী আম বাগানের ধরন বদলে ইউএইচডি পদ্ধতিতে চাষ করতে শুরু করে দিয়েছে। প্রবৃদ্ধি অবশ্য এরই মধ্যে স্থানীয় কৃষক, নার্সারি মালিকদেরকে এই ইউএইচডি বাগানের কৌশলগুলি সম্পর্কে অনুশীলন করতে অনুপ্রাণিত করেছে। প্রযুক্তির সব জায়গায় এই প্রকল্প ছড়িয়ে গেছে, অনলাইনে মার্কেটিং করা, ব্র্যান্ডিং ও বাজারের সঙ্গে সম্পর্ক স্থাপন সহ সব কিছু করেছে। প্রবৃদ্ধি এর মধ্যে আমের প্রচারের জন্য সংযোগ স্থাপন করেছে মোট ৫৭ টি ইকমার্স কোম্পানির সঙ্গে, ৬ জন পাইকারি বিক্রেতা, ৪ জন ব্যক্তিগত ব্যবসায়ী এবং ১৬ জন ফেসবুক ব্যবসায়ীর সঙ্গে যুক্ত হয়েছে।
এই উদ্যোগের প্রভাব বেশ ভালো করেই পড়েছে সবার উপর। ২০২২ সাল হতে এই উদ্যোগের কল্যানে শিবগঞ্জ হতে ৮৭ জন জাতীয় পর্যায়ের এবং ১৩১০ জন দোকানদারের মাধ্যমে CHF এ 1.9 মিলিয়ন মূল্যের আম সংগ্রহ করা হয়েছে। যার ফলে , ১২% খরচ কমে যাওয়ায় ৪০০ জন কৃষক অতিরিক্ত মোট ৪ লাখ টাকা লাভ করতে পেরেছে। যদিও এত বড় লাভের পেছনে আরও দুটি বড় কারন ছিল ১০% ক্ষতি কমে যাওয়া, ও অনলাইনের কারনে ৩৩% ব্র্যান্ড ভেল্যু বৃদ্ধি পাওয়া। এর ফলে আমরা শুধু অনলাইনে স্থানীয় লোকেদের কাছেই বিক্রি করিনি, পাশাপাশি পুরো দেশজুড়ে আম বিক্রি বৃদ্ধি পেয়েছে। ২০২৩ সালে ২৭০ টন প্রিমিয়াম আম বিক্রি হয়েছে। শুধুমাত্র সংযোগ স্থাপনের বাইরে, আম চাষীরা কন্টেণ্ট বানানো , বিজ্ঞাপন কৌশল এবং অন্যান্য অনলাইন মার্কেটিং কৌশল সম্পর্কে মূল্যবান জ্ঞান অর্জন করেছে। – এমনটাই জানিয়েছেন শামিম।
শিবগঞ্জে যেমন ইউএইচডি আমের উৎপাদন বৃদ্ধি পাচ্ছে, তেমনি এর প্রতিযোগিতাও দিনে দিনে বেড়ে চলেছে। এটার কারনে অপচয় হওয়ার সম্ভবনাও দেখা দিচ্ছে। এই ব্যাপারে শামিম বলেন, “যেহেতু প্রতিযোগিতা বৃদ্ধি পেয়েছে, তাই আমরা বাজারে টিকে থাকার জন্য ম্যাংগো সেক্টরের মধ্যে বিকল্প পথ খুঁজছি। এসব সমস্যা থেকে বেরিয়ে আসতে ম্যাংগো সেক্টর প্রবৃদ্ধির কাছে সাহায্য চেয়েছিলাম। পরবর্তী সময়ে তারা থাইল্যান্ডে একটি ট্যুরের আয়োজন করে, যেখানে অ্যাসোসিয়েশনের একদল আম চাষি উন্নতমানের আম প্রক্রিয়াকরণের কৌশলগুলি রপ্ত করে। এরপর শামিম আরও বলেন, আমাদের থাইল্যান্ড ট্যুর টা ছিল ভিন্নরকমের। সেখানে আমাদেরকে উন্নত প্রজাতির আমের বেশ কিছু নতুন ধরনের সঙ্গে পরিচিত হয়েছিলাম। যেমন শুষ্ক আম, ফ্লাট স্কিনের আম ও মশলাদার আমের মত বেশ কিছু আইটেম। এগুলো আমাদের জন্যে একেবারেই নতুন অভিজ্ঞতা ছিল।
থাইল্যান্ডের অভিজ্ঞতায় অনুপ্রাণিত হয়ে, শামীম এবং অন্যান্য আম চাষীরা এখন চলমান বাজারের সাথে মানিয়ে নিয়ে পণ্যের পরিসরে বৈচিত্র্য আনতে এই নতুন জ্ঞান অর্জনের লক্ষ্যে রয়েছে। এখন শামীম ও অন্যান্য আম চাষীরা শুকনো আম উৎপাদনের উপায় খুঁজছেন। তারা উপলব্ধি করতে পেরেছেন যে শুকনো আমের প্রত্যাশিত গুণমান কেবলমাত্র উন্নত যন্ত্রপাতি ব্যবহার করেই অর্জন করা যেতে পারে, যা উপাদেয় আইটেম তৈরির কাজে ডিজাইন করা হয়েছে। প্রতিবারের মতো, তিনি বাজার সংযোগ সহায়তার জন্য প্রবৃদ্ধির সাথে যোগাযোগ করেছিলেন কারণ এই প্রকল্পটি অন্যান্য পৌরসভায় প্রকৌশল খাতের সঙ্গে কাজ করছে। প্রবৃদ্ধি তখন যশোরের লাইট ইঞ্জিনিয়ারিং ফ্যাক্টরি ও ম্যাঙ্গো অ্যাসোসিয়েশনের মধ্যে উচ্চমানের শুকনো আম উৎপাদনের জন্য একটি প্রয়োজনীয় মেশিন তৈরি করার ব্যাপারে আলোচনা করে।
“আমরা প্রোটোটাইপ ডিজাইন করেছি এবং ইতিবাচক ফলাফল পেয়েছি। এর উপর ভিত্তি করে, কারখানার মালিকরা একটি পূর্ণাঙ্গ মেশিন তৈরি করেছে – যা আমাদের একত্রে কাজ করতে অনুপ্রাণিত করেছে। সমন্বয়ের কারণে সংগ্রহ করতে পেরেছি। এখন আমরা পরবর্তী বছরে আমের উৎপাদন করা নিয়ে বেশ রোমাঞ্চিত,” জানান শামীম।
“এই পণ্যগুলির অনেক চাহিদা থাকবে কারণ আমাদের কাস্টমাররা ইতিমধ্যে এই ধরণের প্রক্রিয়াজাত আমের সংগে বেশ পরিচিত। এর ফলে, এই নতুন উদ্যোগটি আরও নতুন কর্মসংস্থান ও আয়ের পথ বৃদ্ধি করবে, বিশেষ করে মহিলাদের জন্য, কারন তাদের জন্য আম বাগানে কাজের খুব বেশি সুযোগ থাকে না।’’ মুখে হাসি নিয়েই স্বপ্ন দেখছিলেন ও এই কথাগুলো বলছিলেন শামিম।